বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বজ্রপাত
অলোক আচার্য
আরও বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে বজ্রপাতও একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতি বছর আমাদের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বহু মানুষ হতাহতের কারণ হয় বজ্রপাত। সারা পৃথিবী আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্থ। একের পর এক ঝড় বন্যা, ভূমিকম্প, টর্নেডো, সাইক্লোন ও সুনামি সবমিলিয়ে বহু প্রাণ এবং সম্পদের ক্ষতির কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মানুষ মানিয়ে নিতে শিখেছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে এভাবেই মানুষকে টিকে থাকা শিখতে হবে। কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশ প্রতি বছরই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পরছে। কালবৈশাখী, ভূমিকম্প, বন্যা এসব দুর্যোগ মানুষের ক্ষতি করেই চলেছে। তবে অনেক প্রকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে বজ্রপাত। অনেক লোকের প্রাণহানির কারণ হয়েছে এই বজ্রপাত। ঘন কালো মেঘ থেকে তৈরি হচ্ছে বজ্রমেঘ। আর সেখান থেকেই বজ্রপাত। পৃথিবীর বিজ্ঞান বহুদূর অগ্রসর হয়েছে কিন্তু বজ্রপাত ঠেকানোর মতো প্রযুক্তি আবিস্কার হয়নি। তবে বজ্রপাত পূর্বাভাসে যন্ত্র রয়েছে। বজ্রপাতে নিহতের অধিকাংশই হাওড় অঞ্চলের। যারা খোলা মাঠে কাজ করছেন তারাই বেশি বজ্রপাতে নিহত হচ্ছে। বজ্রপাতকে ২০১৬ সালে জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় অন্তভুক্ত করেছে সরকার। এক তথ্যে দেখা যায়, ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ১১ বছরে বজ্রপাতে মোট ২ হাজার ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ এবং চলতি বছর প্রাণহানি হয়েছে গড়ে সাড়ে তিনশর বেশি। ২০১১ সালে ১৭৯,২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ২২৬ জন, ২০১৯ সালে ১৯৮ জন এবং ২০২০ সালে ২৫৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বজ্রপাতে। ২০১৬ সাল ৩৯১ জন, ২০১৭ সালে ৩০৭ জন এবং ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন এবং চলতি বছর ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। পৃথিবীর যে কয়েকটি অঞ্চল বজপাত প্রবণ তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া অন্যতম। প্রায় দিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান বলছে, বিশে^ বজ্রপাতে মৃত্যুর এক চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে।
এদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যত মানুষ মারা যায় তার দ্বিতীয় কারণ বজ্রপাত। বজ্রপাতে এভাবে মানুষের মৃত্যুর মিছিল ক্রমদীর্ঘায়িত হওয়ায় মানুষ আজ আতঙ্কিত। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ আর প্রকৃতির সহাবস্থান। মানুষ বুঝতে পেরেছিল প্রকৃতিই তাদের বেঁচে থাকার পথ। তাদের খাদ্য, আশ্রয় আর নিরাপত্তা সবই দিতে পারে প্রকৃতি। তাই প্রকৃতির ওপর মানুষের দখল বাড়তে থাকে। প্রতিনিয়ত অত্যাচারের ফলে প্রকৃতি হয়েছে ভারসাম্যহীন। প্রকৃতির এই ক্ষত যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা মানুষ প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। আবার বুঝতে পারলেও তা থেকে শিক্ষা কোনোদিনই নেয়নি। প্রকৃতির প্রতিশোধ অবশ্যই ফিরে আসে। ফিরে আসে বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে। আজ মানুষের মাথাব্যথার কারণহ হলো এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভূমিকম্পের মতোই বজ্রপাতেও পূর্ব কোনো প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয় না। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো কার্বন নিঃস্বরণ। দেশে বড় বড় গাছপালার সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এটাও বজ্রপাতের হতাহতের একটি অন্যতম কারণ। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি,বন-জঙ্গল উজাড়,বঙ্গোপসাগর থেকে সক্রিয় মৌসুমি বায়ু প্রবাহ,উত্তরের হিমালয় পাদদেশে পুঞ্জিভুত মেঘ,মেঘ সৃষ্টির প্রক্রিয়া,মোবাইল ফোন টাওয়ার থেকে উৎপন্ন অতিমাত্রার ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও ওয়েব বজ্রপাতের জন্য দায়। আরও জানা যায়, বাংলাদেশে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায ৫০ লাখ বা তার বেশি সংখ্যাক বজ্রপাত মেঘ থেকে ভূমিতে নেমে আসে। আমাদের দেশেও বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রাথমিকভাবে বিদেশ থেকে বজ্রপাতে মৃত্যুরোধে ৭২৩ টি ‘আরলি ওয়ার্নি সিস্টেম’ যন্ত্র বসানো হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে বজ্রপাতের ৪০-৪৫ মিনিট আগেই সংকেত পাওয়া যাবে। ফলে সর্তকতা হিসেবে পাশর্^বর্তী কোনো ছাউনিতে আশ্রয় নিতে পারবে। যেহেতু এই ঘটনা হাওড়াঞ্চলেই বেশি ঘটছে তাই এখানেই গুরুত্ব বেশি। এর সাথে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে ‘লাইটার অ্যারেষ্টার’ সম্বলিত বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক কিলোমিটার পর পর এই শেল্টার নির্মাণ করা হবে। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতেও বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ভারতের সর্বাধিক বজ্রপাতপ্রবণ কর্নাটকে সিদিলু নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশগুলোর একটি। প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বাস্তুচুত্য হচ্ছে অগণিত মানুষ। সেসব মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে চাপ বাড়ছে শহরের উপর। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কালবৈশাখি, জ্বলোচ্ছাস, টর্ণেডোসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে গবেষণা বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছে। পরিবেশের পরিবর্তিত প্রভাব নিয়ে চলছে নানা ধরণের সাবধানবাণী। আমাদের জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। যখন শীত আসার কথা তখন না এসে শীত আসছে দেরীতে। আবার যখন বৃষ্টি হওয়ার দরকার তখন না হয়ে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টি হলো। পরিবেশের বিরুপ অবস্থার সাথে লড়াই করার মত পর্যাপ্ত সামর্থ আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। বিগত বছরগুলোতে আইলা বা সিডর বা নার্গিসের মত প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকালে সহজেই আমরা তা অনুমান করতে পারি। আজও সেসময়কার ক্ষতিগ্রস্থরা তাদের সে দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সংগ্রামের রেশ থামতে না থামতেই আবারো নতুন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের উৎপত্তি হচ্ছে। নিত্যনতুন নাম আর ভয়ংকর চেহারা নিয়ে আমাদের সাজানো গোছানো সংসারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যাচ্ছে। যখনই সংকট সামনে এসেছে তখনই আমরা এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি। তারপর ধীরে ধীরে সেই বিষয়টা আমরা ভুলতে থাকি। বজ্রপাত নাম প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আমাদের শঙ্কা শুরু হয়েছে গত কয়েক বছর ধরেই। পরিবেশ বদলে যাওয়ার সাথে সাথে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কৃষক, জেলে অর্থাৎ উন্মুক্ত স্থানে থাকা মানুষের সংখ্যাই বেশি। বজ্রপাতে হতাহত প্রতিরোধ করতে সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষ সচেতন হলেই বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমে আসবে। প্রচুর গাছপালা রোপন করতে হবে। বজ্রপাত প্রতিরোধে তালগাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ গত কয়েক দশকে তাল গাছের সংখ্যা কমেছে। রাস্তার পাশে ও পতিত জায়গায় তালগাছসহ অন্যান্য গাছ রোপন করে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। বজ্রপাতে হতাহত কমিয়ে আনতে এখনই সবাইকে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।