ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আগামী পহেলা মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে জাটকা রক্ষা কার্যক্রম। এপ্রিলের ৩০ তারিখ পর্যন্ত টানা দুইমাস চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ৭০ কিলোমিটার এলাকায় জেলেদের নদীতে নামার ওপর থাকবে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এই দুই মাস নদীতে নামতে না পারলে কিস্তির বেড়াজালে আটকে পড়বেন জেলেরা। প্রতিবছর অভয়াশ্রমের আগে বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধের চিন্তায় তাদের কপালে পড়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। তাই নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে এসব কিস্তি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন জেলেরা।
ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০০৩-০৪ সাল থেকে অক্টোবর মাসে ‘মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম’ ও ‘মার্চ-এপ্রিল’ দুই মাস ‘জাটকা নিধন রক্ষা কার্যক্রম’ বাস্তবায়ন করে আসছে সরকার। নিষেধাজ্ঞার এই সময় জেলেরা যাতে নদীতে মাছ শিকারে না নামে তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু জেলে নদীতে নেমে পড়েন। যার অন্যতম কারণ হিসেবে তারা দাবি করেন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ।
নিষেধাজ্ঞার সময় তারা অন্য কোনো কাজ করতে না পারায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ তাদের জন্য ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’ হয়ে দাঁড়ায়। সংসারের খরচ চালিয়ে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর এতেই অনেক জেলে বাধ্য হয়ে এ সময় নদীতে মাছ শিকারে নেমে পড়েন।
রাজরাজেস্বর ইউনিয়নের জেলে হাসেম মাঝি, জয়নাল খান, সবুজ গাজীসহ বেশ কয়েকজন জানান, আমরা মূলত নদীতে মাছ ধরার নৌকা, জাল বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি কেনার জন্য ঋণ নিই। আমরা কখনোই নিজেদের সংসার চালানোর জন্য লোন বা কিস্তি নিই না। অনেক সময় নতুন জাল নিয়ে নদীতে গেলেই বড় বড় জাহাজের পাখায় আটকে আমাদের জাল পুরো ছিঁড়ে যায়। অনেক সময় জাহাজের সঙ্গে পুরো জাল চলেও যায়। তখন আমাদের আবার জাল বুনতে কিস্তি নিতে হয়। আমরা গরিব মানুষ, কিস্তি ছাড়া টাকা পাবো কোথায়?
তারা বলেন, যখন নদীতে মাছ ধরতে পারি তখন আমাদের কিস্তি পরিশোধ করতে কোনো কষ্ট হয় না। কিন্তু যখন অভিযান চলে বা নিষেধাজ্ঞা চলে তখন আমরা কিস্তি দেবো কিভাবে। নিজেদের সংসার চালাইতেই কষ্ট হয়ে যায়।
তারা বলেন, কিস্তির টাকা দিতে না পারলে এনজিওর লোকজন বাড়িতে এসে হামতাম করে। অনেক সময় গালমন্দ করে। পরিবারের সামনে অনেক সময় লজ্জা পেতে হয়। দুই মাসে কতগুলো কিস্তি দিতে হয়। যেহেতু আমরা নদীতে মাছ ধরতে নামতে পারি না বা অন্য কোনো কাজও জানি না তাই আমরা কিস্তিও দিতে পারি না।
তাই আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, অন্তত নিষেধাজ্ঞার এই সময়গুলোতে যাতে এনজিওর এসব কিস্তিগুলো বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করে। তাহলে অনেক জেলেই নদীতে নামবে না বলে আমরা মনে করি।
এ বিষয়ে চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার মানিক বলেন, তারা মূলত তাদের ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি সরকার যদি এসব প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞার সময় আলাদা পলিসি করার সুপারিশ করে বা এই কিস্তি তোলা বন্ধ রাখা হয় তাহলে আমার বিশ্বাস ওই সময় জেলেরা নদীতে কম নামবে। এক্ষেত্রে অভিযানগুলো ফলপ্রসূ হতে পারে।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, অভয়াশ্রমের আগেই বিষয়টি নিয়ে আমরা এনজিও সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবো। তাদের এই কিস্তির জন্য আমাদের জেলেদের যে ধরনের অসুবিধা হয় সেগুলো তুলে ধরে আমি আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করবো এই দুই মাস অন্তত কিস্তি টাকা যাতে বন্ধ থাকে।
উল্লেখ্য, পদ্মা ও মেঘনার চাঁদপুরের সীমানায় বর্তমানে ৪৪ হাজার ৩৫ জন জেলে নদীতে ইলিশ ও বিভিন্ন প্রকার মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। অভয়াশ্রম বাস্তবায়নে ও নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে নদীতে জেলেরা যাতে না নামে সেজন্য সরকার তাদের বিকল্প আয়বর্ধক প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করছে। পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার সময় কিস্তি শিথিল করা হলে জেলেদের নদীতে নামার প্রবণতা কমবে বলে মনে করেন অনেকেই।