ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফরিদগঞ্জের ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত শিমুল মিজিসহ কিশোর গ্যাং কুশীলবদের চিহ্নিত ও ব্যবস্থা নেয়ার দাবি

হাট-বাজার করে দেয়া, চা-সিগারেট এনে দেয়াসহ সকল কাজই সে করতো। ফলে অল্প দিনেই সে নেতাদের আস্থাভাজন হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সাথে সাথে নেতাও পরিবর্তন হয় তার। ফরিদগঞ্জ উপজেলার আষ্টা এলাকার ধর্ষণকা-ে অভিযুক্ত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য শিমুল মিজির কথা এগুলো।

ধর্ষণ কা-ের পর শিমুল মিজির উত্থান কাহিনী জানতে এলাকায় গিয়ে নানা তথ্য জানা গেল। উপজেলার ৫নং গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নে সাইসাঙ্গা গ্রামের মোঃ হারুন মিজির ৪ ছেলে ২ মেয়ের মধ্যে শিমুল সকলের ছোট। সহজ সরল পিতার ঘরে এই কিশোর অপরাধী চক্রের অন্যতম প্রধান শিমুলের জন্ম। বাবা শত চেষ্টা করেও তাকে পড়ালেখা করাতে পারেন নি। এই সুযোগে রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে বড় বড় প্রোগ্রাম সফল করার লক্ষ্যে তৈরি করেন কিশোর গ্যাং, জড়িয়ে যান মাদক সেবনেও। তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলে ইমারজেন্সি হুইসেল, ক্ষুদ্র বিষয়ে মানুষকে অস্ত্র প্রদর্শন, ভূমি দখলে সহযোগিতা, ইভটিজিং, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সাথে জড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। গণমাধ্যমেও ছাপা হয়েছে তার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের এইসব কার্যকালাপ নিয়ে সংবাদ। তারপরেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলো শিমুল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।

কিশোর অপরাধের প্রভাব বিস্তারকারী শিমুল যুবলীগ নেতা নাম দিয়ে স্থানীয় এবং বর্তমান যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ছবি ব্যবহার করে ওই ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঝুলিয়ে নিজের পরিচয় তুলে ধরতো। এমনকি বড় বড় নেতাদের সাথে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়।

স্থানীয় লোকজন জানান, শিমুল মিজির রাজনীতির সাথে পদচারণা শুরু হয় গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা মোহনের হাত ধরে। শিমুল এ সময় মোহনসহ আশপাশের নেতাদের নানা ফরমায়েশ খাটতো। বাড়ির সওদা করাসহ সকল কাজই করে দিতো সে। ফলে অল্প দিনেই শিমুল সকলের আস্থাভাজন হয়ে যায়। যদিও ওই সময়ে তার অপরাধে জড়িত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আচরণও পাল্টাতে থাকে শিমুল মিজির। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ক্ষমতার পালাবদলের কারণে শিমুল মিজি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নতুন নেতার দলে ভিড়ে। গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়ন বাদ দিয়ে তাদের পদচারণা বাড়ে গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নে। সংসদ সদস্যের ওই ইউনিয়নের স্থানীয় প্রতিনিধি সোহেল হোসেনের সাথে চলাফেরা শুরু হয়। স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও থাকা বিভিন্ন ছবিতে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুনেও দেখা দেখা গেছে নেতাদের সালাম জানিয়ে শিমুল গংয়ের ছবি। এছাড়া ২০২১ সালে করোনাকালীন সময়ে উপজেলা যুবলীগ বিভিন্ন ইউনিয়নে যুবলীগের ত্রাণ কমিটি গঠন করে। গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের ত্রাণ কমিটিতে শিমুল মিজির নাম রয়েছে। ফলে সে রাজনৈতিক খুঁটি পায়।

উপজেলার আষ্টা বাজার ব্যবসায়ী, রিপন, শহীদ হোসেন, কাউছার আলম বাবুসহ বেশ কজন বলেন, শিমুল ছেলেটি আগে ভালোই ছিল, মানুষের সকল কাজ-কর্ম করতো। গত ক’বছরে প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় শিমুল বেপরোয়া হয়ে উঠে। ক্ষমতার দাপটে তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতো। উচ্চ শব্দ ও প্রচ- গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে সে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতো।

খাজুরিয়া বাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক’জন ব্যবসায়ী জানান, শুধু শিমুল নয়, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত রয়েছে সিয়াম, কিরণসহ আরো কিছু কিশোর। তারা জানান, স্থানীয় এমপির প্রতিনিধি সোহেল মাস্টারের সাথে শিমুল, সিয়াম, কিরণদের ঘনিষ্ঠতার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। শিমুলরা গত তিনবছরে ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতে না পারলে আষ্টার ধর্ষণ কা-ই নয়, আরো অনেক ভয়ানক ঘটনার জন্ম হতে পারে। একই সাথে এদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া কুশীলবদের চিহ্নিত ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

সম্প্রতি অস্ত্র নিয়ে খাজুরিয়া বাজারে প্রকাশ্যে ঘোরা কিশোর গ্যাংয়ের একজন কিরণের ছবির সন্ধান মিলছে। ২০২১ সালের এই ছবিতে দেখা যায়, একবার পিস্তল হাতে নিয়ে এবং আরেকটি ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে এই কিরণ। স্থানীয়রা জানান, এই কিরণই পুলিশের হাতকড়াসহ পালিয়ে গিয়েছে বলে তারা শুনেছেন। শিমুলের ধর্ষণকা-সহ নানা অপরাধ, কিরণের এভাবে অস্ত্র নিয়ে ঘোরা, কিশোর গ্যাং লিডার সিয়াম এবং তাদের বাহিনীর সদস্যদের আচরণে ক্ষুব্ধ দুই ইউনিয়নের এলাকাবাসী। তারা এদের দ্রুত আটকের পাশাপাশি তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দাতাদের বিষয়ে প্রশাসন এবং দলের নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি রবিন জানান, কিছুদিন পূর্বে কিশোর গ্যাং লিডার শিমুল যেভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে আমার পাশ দিয়ে গেছে, আমি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছি। আমি সেই সময়েই সোহেল মাস্টারের অফিসে গিয়ে এর কারণ জানতে চেয়েছি।

উপজেলা যুবলীগের সদস্য আনোয়ার হোসেন বিপ্লবের ছবি দিয়ে শিমুল মিজির বেশ কিছু ফেস্টুন এখনো এলাকায় রয়েছে। এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বিপ্লব বলেন, রাজনীতি করতে হলে সকল মানুষের সাথে কাজ করতে হয়। প্রথমে তার সম্পর্কে জানতাম না, জানার পরে ভালো হতে বিভিন্ন সময় ঢাকায় কাজ করার জন্য পাঠাইছি। কিন্তু তাকে ভালো করতে পারিনি, অপরাধী যেই হোক তার শাস্তি আমি চাই।

গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় এমপির প্রতিনিধি সোহেল মাস্টার বলেন, শিমুলের আড্ডা ছিল আষ্টা বাজার এলাকায়। সে বখাটে ছেলেদের সাথে চলার কারণে তাকে বাধা দিয়েছি। কিন্তু তাকে নেশা করতে দেখিনি, কিছু বখাটের সাথে চলার কারণে আমি তাকে খাজুরিয়া আসতে নিষেধ করেছি। এই কারণে সে গত কয়েক মাস আমার সাথে নেই।

গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ বলেন, শিমুলসহ কিশোর গ্যাংকে রুখতে হবে। এদের এভাবে যা ইচ্ছা তা করতে দেয়া যায় না।

উল্লেখ্য, গত ৯ জানুয়ারি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ৪ বখাটে কর্তৃক ১০ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ কা-ের মূল হোতা এই শিমুল।

সর্বশেষ - ফরিদগঞ্জ

জনপ্রিয় - ফরিদগঞ্জ